বাংলা বানান সংস্কার : বাংলা বানানের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানকল্পে যেসব উদ্যোগ ও প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তা নিম্নরূপ-
- ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘বাংলা বানানের নিয়ম’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশ ও ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ ।
- বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাংলা বানানের সমতা বিধানের নীতিমালা প্রণয়ন।
- ১৯৯২ সালে ‘বাংলা একাডেমি’ কর্তৃক ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রণয়ন।
- সর্বশেষ ২০১২ সালে আবার পূর্বোক্ত নিয়মের পরিমার্জিত সংস্করণের প্রকাশ।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
১. তৎসম শব্দ
১.১ এই নিয়মে বর্ণিত ব্যতিক্রম ছাড়া তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।
১.২ যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয়ই শুদ্ধ কেবল সেসব শব্দে ই বা উ এবং তার কার (↑, ) চিহ্ন হবে। যেমন— কিংবদন্তি, চুল্লি, পল্লি, দাবি, মসি, যুবতি, রচনাবলি, ঊষা, ঊর্ণা।
১.৩ রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন— পৰ্দ্দা, কাৰ্য্য না হয়ে বরং পর্দা, কার্য হবে।
১.৪ সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তঃস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন— সম্ + কর = সংকর, সম্ + যম = সংযম। সন্ধিবদ্ধ না হলে ঙ স্থানে হবে না। যেমন—অঙ্ক, অঙ্গ, আতঙ্ক।
১.৫ সংস্কৃত ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপ সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোতে হ্রস্ব ই-কার হবে। যেমন— গুণী → গুণিজন, মন্ত্রী → মন্ত্রিসভা, প্রাণী → প্রাণিজগৎ । তবে এগুলোর সমাসবদ্ধ রূপে ঈ-কারের ব্যবহারও চলতে পারে। ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দের সঙ্গে ‘ত্ব’ ও ‘তা' প্রত্যয় যুক্ত হলে ই-কার হবে। যেমন— কৃতী → কৃতিত্ব, সহযোগী-সহযোগিতা ইত্যাদি।
১.৬ বিসর্গ (ঃ)-এর ব্যবহার : শব্দের শেষে সাধারণত বিসর্গ (ঃ) বসবে না।যেমন— কার্যত, মূলত, ক্রমশ ইত্যাদি।
২.অ-তৎসম অর্থাৎ দেশি, বিদেশি, মিশ্র ও তদ্ভব শব্দ
২.১ ই, ঈ, উ, ঊ সকল অ-তৎসম শব্দ অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে কেবল ই, উ-কার এবং এদের কারচিহ্ন (,) ব্যবহৃত হবে। যেমন— ফরাসি, ফরিয়াদি, ফিরিঙ্গি, সরকারি, মামি, খুশি, বুড়ি, চুন, মুলা, ভুখা ইত্যাদি ।
২.২ পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন— লোকটি, নদীটি, গাছটি ইত্যাদি।
২.৩ বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়াবিশেষণ ও যোজক পদরূপে ‘কী’ শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন— এটি কী গাছ? তুমি কী দেখছো? কী দুরাশা!
২.৪ তবে যেসব ক্ষেত্রে বাক্যের ক্রিয়াকে প্রশ্ন করলে হ্যাঁ বা না উত্তর আসে সেসব ক্ষেত্রে বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার (1) দিয়ে লেখা হবে। যেমন— তুমি কি খাচ্ছ? তুমি কি গান গেয়েছো? ইত্যাদি।
২.৫ কেবল তৎসম শব্দের বানানে ণ ও ষ ব্যবহৃত হবে। কোনো প্রকার অ তৎসম শব্দে অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে ণ ও ষ ব্যবহৃত হবে না। যেমন— কোরান, বন, কান, শার্ট, হিসাব, শামিয়ানা, শৌখিন ইত্যাদি।
২.৬ –আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও-কার (61) যুক্ত হবে। যেমন— করানো, খাওয়ানো, শোয়ানো, দোলানো।
২.৭ হস-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন— টন, বল, শখ, টাক ইত্যাদি।
২.৮ ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন— ক’ল = করিল, দু’জন = দুজন।
৩. বিবিধ
৩.১ যুক্তব্যঞ্জনবর্ণগুলি যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলোর স্পষ্ট রূপ দিতে হবে এবং তার জন্য কতকগুলি স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন— গু, রু, শু, দ্রু, ভু
৩.২ সমাসবদ্ধ শব্দগুলি একসাথে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা যাবে না। যেমন—বিষাদমণ্ডিত, পূর্বপরিচিত, সংযতবাক্য। হয়তো বিশেষ প্রয়োজনে এক বা একাধিক হাইফেন দিয়ে যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন— জল-স্থল-আকাশ, সদ্য-চুলে-পাক-ধরা মাথা, হলদে-সুতা- জড়ানো শাঁখা ইত্যাদি।
৩.৩ বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সাথে যুক্ত হবে না। যেমন- ভালো মেয়ে, সুন্দর দিন, বিচিত্র পৃথিবী
৩.৪ না-বাচক না, নি-এর প্রথমটি (না) স্বতন্ত্র পদ হিসেবে এবং (নি) সমাসবদ্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। যেমন— করি না, করিনি, যাই না, যাইনি। তবে অনেক সময় অর্থকে স্পষ্ট করার জন্য না-এর পরে হাইফেন যোগ করা যায়। যেমন—না-বলা কথা, না-শোনা কথা ইত্যাদি।
৩.৫ অধিকন্তু অর্থে ব্যবহৃত ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের সঙ্গে কার-চিহ্ন যুক্ত না হয়ে পূর্ণ রূপ শব্দের পরে যুক্ত হবে। যেমন— আজও, আমরাও, তোমারও, কালও ইত্যাদি। তাছাড়া নিশ্চয়তা অর্থে ই পূর্ণ রূপে ব্যবহৃত হবে। যেমন—আজই, যাবই ইত্যাদি।
৪. বাংলা বানানের অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিয়ম
বাংলা বানানের নানা ধরনের নিয়মের মধ্যে কিছু নিয়ম আছে, যেগুলো মনে রাখলে অনেক কঠিন বানানও মনে রাখা সহজ হয়ে যায়। এ রকমই কয়েকটি নিয়ম নিচে তুলে ধরা হলো।
ইক-প্রত্যয়জাত শব্দ
বৈচারিক, প্রশাসনিক, ব্যবহারিক, সমসাময়িক, আর্থনীতিক, রাজনীতিক।
একবচনে ঈ-কার বহুবচনে ই-কার
সংস্কৃত ই-প্রত্যয়ান্ত যেসব একবচন-বাচক শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ থাকে, বহুবচনে তা হ্রস্ব ই-কার’ রূপ ধারণ করে। যেমন-
মন্ত্রী : মন্ত্রিবর্গ, মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রিগণ
প্রাণী : প্রাণিকুল, প্রাণিজগৎ
কর্মী : কর্মিবৃন্দ, কর্মিগণ, কর্মিদল
প্রার্থী : প্রার্থিগণ, প্রার্থিবৃন্দ, প্রার্থিরা
হস্তী : হস্তিযূথ, হস্তিদল, হস্তিবাহিনী
অন্তে ‘তা/তৃ-যুক্ত শব্দের রূপান্তর
কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তৎসম তৃচ্-প্রত্যয়ান্ত বা অন্তে ‘তা’ বা ‘তা’ যুক্ত কোনো শব্দের শেষে কোনো চিহ্ন/বর্ণ কিংবা শব্দ/শব্দাংশ যুক্ত হলে ওই ‘তা’ বা ‘র্তা’ পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে ‘তৃ’ ও ‘তৃ’ রূপ ধারণ করে। যেমন-
- কর্তা : কর্তৃবৃন্দ, কর্তৃগণ, কর্তৃমণ্ডলী, কর্তৃপক্ষ, কর্তৃভবন, কর্তৃরূপ, কর্তৃবিয়োগ, কর্তৃহীন, কর্তৃতর্পণ, কর্তৃবৎ, কর্তৃস্থানীয়, কর্তৃভক্তি, কর্তৃহন্তা, কর্তৃকুল প্রভৃতি।
- কর্মকর্তা : কর্মকর্তৃবৃন্দ, কর্মকর্তাগণ, কর্মকর্তৃবৎ, কর্মকর্তৃভবন, কর্মকর্তৃমণ্ডলী, কর্মকর্তৃতুল্য, কর্মকর্তৃপরিষদ, কর্মকর্তৃসংঘ, কর্মকর্তহীন, কর্মকর্তৃবিয়োগ প্রভৃতি।
- দাতা : দাতৃবৃন্দ, দাতৃগণ, দাতৃমণ্ডলী, দাতৃভক্তি, দাতৃমৃত্যু, দাতৃবিয়োগ, দাতৃহীন, দাতৃবৎ, দাতৃবন্দনা, দাতৃসদন, দাতৃসংঘ, দাতৃকুল প্রভৃতি ।
- মাতা : মাতৃস্নেহ, মাতৃভাষা, মাতৃদুগ্ধ, মাতৃভক্তি, মাতৃকুল, মাতৃত্ব, মাতৃস্তন্য, মাতৃকল্যাণ, মাতৃবৎ, মাতৃবন্দনা, মাতৃভূমি, মাতৃমৃত্যু, মাতৃবিয়োগ, মাতৃহীন প্রভৃতি।
- পিতা : পিতৃব্য, পিতৃপুরুষ, পিতৃগৃহ, পিতৃঋণ, পিতৃধন, পিতৃতর্পণ, পিতৃধর্ম, পিতৃসত্য, পিতৃষ্ণসা, পিতৃহন্তা, পিতৃসম্পত্তি, পিতৃকল্প, পিতৃপক্ষ, পিতৃলোক, পিতৃস্থানীয় প্রভৃতি ।
- ভ্রাতা : ভ্রাতৃবৃন্দ, ভ্রাতৃগণ, ভ্রাতৃমণ্ডলী, ভ্রাতৃসংঘ, ভ্রাতৃপ্রতিম, ভ্রাতৃপ্রেম, ভ্রাতৃবিদ্বেষ, ভ্রাতৃকলহ, ভ্রাতৃবধূ, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া প্রভৃতি ।
- নেতা : নেতৃবৃন্দ, নেতৃগণ, নেতৃত্ব, নেতৃবৎ, নেতৃবিয়োগ, নেতৃদেশ, নেতৃভক্তি, নেতৃহন্তা, নেতৃস্থানীয়, নেতৃপক্ষ, নেতৃকল্প, নেতৃতর্পণ, নেতৃকলহ প্রভৃতি ।
- শ্রোতা : শ্রোতৃবৃন্দ, শ্রোতৃগণ, শ্রোতৃমণ্ডলী, শ্রোতৃকুল, শ্রোতৃবৎ, শ্রোতৃহীন, শ্রোতৃসংঘ, শ্রোতৃকলহ, শ্রোতৃকল্প, শ্রোতৃস্বরূপ প্রভৃতি।
বহুবচনে ‘টা’ ও ‘ধা’-এর পরিবর্তন
যেসব তৃচ্-প্রত্যয়ান্ত একবচন-বাচক শব্দের শেষে ‘তা’-এর পরিবর্তে টা’ বা ‘ধা’ থাকে, সেসব শব্দের বহুবচনে ‘টা’ বা ‘ধা’-এর স্থলে যথাক্রমে ‘টু’ ও ‘ধূ’ হয় । যেমন-
উপদেষ্টা : উপদেষ্টগণ, উপদেষ্টবৃন্দ, উপদেষ্টমণ্ডলী
স্রষ্টা : সৃষ্টগণ, সৃষ্টবৃন্দ, সৃষ্টমণ্ডলী
দ্রষ্টা : দ্রষ্টগণ, দ্রষ্টবৃন্দ, দ্রষ্টমণ্ডলী
যোদ্ধা : যোদ্ধৃগণ, যোদ্ধৃমণ্ডলী, যোদ্ধৃবর্গ
বোদ্ধা : বোদ্ধৃগণ, বোদ্ধৃমণ্ডলী, বোদ্ধৃবৃন্দ
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অশুদ্ধ বানানের শুদ্ধ রূপ
Post a Comment