ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব

* ইন্টারনেট : বিশ্বের সেতুবন্ধন

* ইন্টারনেট : বিশ্বের সেতুবন্ধন

* ইন্টারনেট ও বর্তমান বাংলাদেশ

ভূমিকা : ইন্টারনেট কম্পিউটার বাহিত এমনই এক সংযোগ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বই চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। এর সাহায্যে মানুষ উন্নীত হয়েছে এমন এক স্তরে যেখানে সারা বিশ্বের সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে এর মাধ্যমে। সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসেছে এক অভাবনীয় সাফল্য।

ইন্টারনেট কী? : ইন্টারনেট হচ্ছে কম্পিউটার নেটওয়ার্কসমূহের একটি বিশ্ব ব্যবস্থা। এটি এমন একটি নেটওয়ার্ক বা জাল বিস্তার যার সাথে অনেক ক্ষুদ্র কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সংযোগ আছে। প্রতিটি শহরের মহাসড়কের সাথে যেমন অন্যান্য রাস্তা, গলি ও উপগলির যোগাযোগ রয়েছে ঠিক তেমনি ইন্টারনেট নামক নেটওয়ার্কের সাথে অন্যান্য ক্ষুদ্র কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সংযুক্ত। এদিক দিয়ে একে নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক বলা যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের কম্পিউটার থেকে অন্য প্রান্তের আর একটি কম্পিউটারে ছবিসহ যাবতীয় তথ্য দ্রুত সংগ্রহ ও প্রেরণ করা যায়। ইন্টারনেট একটি বিশাল ‘নেটওয়ার্কিং সিস্টেম' যার বিস্তৃতি পৃথিবীময়। বিশ্বের লাখ লাখ বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি লোকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইন্টারনেট ।

উদ্ভব ও অগ্রগতি : ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা মাত্র ৪টি কম্পিউটারের সাহায্যে গড়ে তুলেছিলেন প্রথম অভ্যন্তরীণ এক নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার নাম ছিল ‘ডার্পানেট’ । তিন বছর যেতে না যেতেই কম্পিউটারের সংখ্যা চার থেকে তেত্রিশ-এ পৌঁছায়। এর চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলে। ক্রমশ চাহিদার ভিত্তিতে ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ‘নেস্ফেনেট’ নামে সর্বসাধারণের জন্যে অন্য রকম একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে। তখন তা ছিল কেবল গবেষণার কাজে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম। তিন বছরের মধ্যে নেস্ফেনেট সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে গড়ে ওঠে আরও অনেক ছোট-বড় ‘নেটওয়ার্ক'। এর ফলে এ ব্যবস্থায় কিছুটা অরাজকতা দেখা দেয়। এ অরাজকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ জন্যেই ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে গড়ে তোলা হয় একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক। বিশ্বের মানুষ পরিচিত হয় ‘ইন্টারনেট’ নামক একটি ধারণার সঙ্গে। ১৯৯৩ সালে ইন্টারনেটকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আর এর কয়েক মাসের মধ্যেই লাখ লাখ নতুন সদস্য ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে কেন্দ্ৰীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিশ সহস্রাধিক নেটওয়ার্ক যুক্ত হয়েছে। আর এর ব্যবহারকারীদের সংখ্যা এখন তিন কোটিরও বেশি। এই সংখ্যা প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এভাবে সারা পৃথিবীকে ইন্টারনেট জালের মতো জড়িয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট : ১৯৯৩ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। শুরুর দিকে ইন্টারনেট অফলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা ছাড়াও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মেইন সার্ভিস দিয়ে আসছিল। কিন্তু অফলাইনে সংযুক্ত থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তথ্যের বিশাল জগতের সকল সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। ই-মেইলের কেবল ডাউনলোড (তথ্য গ্রহণ) ও আপলোড (তথ্য প্রেরণ) করা যেত। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৫ই জুলাই থেকে বাংলাদেশে অনলাইন ইন্টারনেট সেবা প্রদান শুরু হয়। বাংলাদেশ ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির এক বিশাল জগতে প্রবেশ করে। এর ফলে ইন্টারনেট  ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার। ২০০০ সালের শুরুতে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৬০ হাজারে। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা সাড়ে চার কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

ইন্টারনেটের সুবিধা : ইন্টারনেটের ব্যবহার মানুষের জীবনে এনেছে বিপুল পরিবর্তন। এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আজ অসম্ভবকে করেছে সম্ভব। এর সাহায্যে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে যে-কোনো সময়ে তথ্য বা খবর প্রেরণ করা যায় এবং সেখান থেকে নতুন তথ্য পাওয়া সম্ভব। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, বিনোদন, বিপণন ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। এর দ্বারা কোনো দেশের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া অন্য দেশের লোক সহজেই জানতে পারছে। কোনো দেশের শেয়ার বাজারের অবস্থা ও দেশের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থাও অন্য দেশের লোকে সহজেই জেনে নিতে পারছে। ইন্টারনেটের সাহায্যে বিশ্বের যে-কোনো প্রান্ত হতে যে কেউ প্রবেশ করতে পারছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিতে, সেখানকার বিভিন্ন বই থেকে তথ্যও সংগ্রহ করতে পারছে। বর্তমানে দূরশিক্ষণে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো ছাত্র শিক্ষকের কাছ থেকে পড়া বুঝে নিতে পারে। বিনোদনের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের একজন লোকের পক্ষে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিউইয়র্কের কোনো ওপেন এয়ার কনসার্ট উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে বাংলাদেশের একজন রোগী বিদেশের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারছেন। বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দেশে বসে অন্য দেশের জিনিসপত্র কেনাকাটা করাও সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলা, গান শোনা, সিনেমা দেখা, রান্না শেখা, ফ্যাশন সম্পর্কে জানা এমনকী বিয়ের সম্পর্কও প্রতিষ্ঠা করা যায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। 

ইন্টারনেটের সুবিধাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : (১) ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, (২) ই-মেইল, (৩) নিউজগ্রুপ, (৪) টেলনেট, (৫) গোফার ও (৬) ফাইল ট্রান্সফার। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব দ্বারা অন্যান্য কম্পিউটারের তথ্যাদি পড়া ও শোনা যায়। ই-মেইল দ্বারা অন্য কম্পিউটারের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। ইন্টারনেটে প্রকাশিত প্রতিদিনের পত্রিকার পাঠক হওয়া যায় নিউজগ্রুপের মাধ্যমে। টেলনেটের মাধ্যমে সরাসরি কম্পিউটারে টাইপ করে অন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সাথে তথ্য বিনিময় করা যায়। গোফারের সাহায্যে ইন্টারনেট হতে কোনো ফাইল খুঁজে বের করে তা নিজ কম্পিউটারে কপি করা যায়। আর ফাইল ট্রান্সফারের মাধ্যমে এক কম্পিউটার হতে অন্য কম্পিউটারে ফাইল আদান-প্রদান ও ফাইল সংরক্ষণ করা যায়। এক কথায় ইন্টারনেট বিশ্বের তথ্য সমুদ্র থেকে মণিমুক্তা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ডুবুরির কাজ করে। ইন্টারনেটের এই বহুবিধ ব্যবহারের কারণেই বিশ্ববাসী আজ প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হচ্ছে।

ইন্টারনেটের অসুবিধা : সব কিছুরই যেমন ভাল ও খারাপ দিক আছে তেমনি ইন্টারনেটও এর ব্যতিক্রম নয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিছু ব্যবহারকারী বা ভোক্তা মিথ্যা তথ্য প্রদান, পর্নোগ্রাফির চিত্র আদান-প্রদান, কিংবা জুয়া খেলার মতো অনুচিত কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কেউ কেউ কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের লাখ লাখ কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ইন্টারনেট ওয়ার্ম’ নামক ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে কয়েক হাজার কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত করে। ‘চেরোনোবিল ভাইরাস' নামক একটি ভাইরাস বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ চালিয়ে সারা বিশ্বের লাখ লাখ কম্পিউটার অকেজো করে দেয়। কিছুকাল আগে ‘লাভবাগ’ নামক একটি ভাইরাসও বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে। ভাইরাস হলো একপ্রকার কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা অন্য কম্পিউটারের স্মৃতি ধ্বংস করতে সক্ষম। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের তেরো বছর বয়সী তিনজন ছাত্র তাদের স্কুলে ফিট্ করে রাখা বোমা ফাটায়। ইন্টারনেট হ্যাকাররা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য কম্পিউটারের সকল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এর ফলে অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। অর্থাৎ ইন্টারনেটের সাহায্যে মানুষ যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতিরও শিকার হচ্ছে। তবে এজন্যে ইন্টারনেট পদ্ধতিকে দোষ দেওয়া যায় না। বরং এর সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্যে বিশ্ববাসীকেই সচেতন হতে হবে।

ইন্টারনেট সুংযুক্তিকরণ : ইন্টারনেট সংযুক্তিকরণের জন্যে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন একটি কম্পিউটার। কম্পিউটারের সাথে লাগে একটি মডেম। ইন্টারনেট সার্ভিস দেয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট ফি-র বদলে ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করা চলে। সাধারণত যে প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান করে তারাই ইন্টারনেট ব্যবহারের সংযোগ ও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার প্রদান করে। তবে ব্যবহারকারীকে ইন্টারনেট ব্যবহারের নিয়ম জানতে হয়।

উপসংহার : ইন্টারনেট বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা। ইন্টারনেট আজ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছে। এর মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যদি ইন্টারনেটের অপকারিতা বন্ধের লক্ষ্যে একত্রে কাজ করেন তাহলেই ইন্টারনেট মানব জীবনে আরও অগ্রগতি এনে দিতে সক্ষম হবে। আগামী দিনে হয়তো এই ইন্টারনেট ব্যবস্থাই সারা পৃথিবীর সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করবে।

[ অনুরূপ রচনা : বিশ্বযোগাযোগ ও ইন্টারনেট]

আর্টিকেলের শেষকথাঃ   ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব - প্রবন্ধ রচনা 

শিক্ষার্থীরা  আজকে আমরা জানলাম  ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব - প্রবন্ধ রচনা সম্পর্কে  । যদি আজকের এই  ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব - প্রবন্ধ রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD


Post a Comment

Previous Post Next Post