বাদল দিনে
আজকের দিনটা
একেবারে অন্যরকম। সকাল থেকেই সারা আকাশ কালো মেঘের কুণ্ডলীতে ঢাকা। ক্ষণে ক্ষণে
কানে বাজছে গুরু গুরু ধ্বনি—যেন মেঘের
মৃদঙ্গ। একটানা বৃষ্টি পড়ছে রিমঝিমিয়ে—যেন নূপুরের নিক্কণ। তারই ফাঁকে ফাঁকে কখনো বৃষ্টি নেমে আসছে মুষলধারে—
ঝর ঝর অবিরল ধারায়। আর
কখনো কখনো ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা খেয়ে তেড়ে আসছে মাতাল বৃষ্টি—দরজা জানালার ফাঁক গলিয়ে ঢুকে পড়ছে ঘরের
ভেতরে।
আজ আমার ঘুম
ভেঙেছে বৃষ্টির শব্দে। বাইরে তাকিয়ে দেখি, আকাশের যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। জলের ছোঁয়ায়
গাছের পাতায় পাতায় জেগেছে রুপোলি শিহরন। বৃষ্টির ঝাপটায় চারপাশ যেন ঢেকে আছে
কুয়াশার স্বচ্ছ চাদরে। মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, কদম আর কেয়া বনে আজ দারুণ হুটোপুটি— কে কার আগে অবগুণ্ঠন খুলে বেরিয়ে আসবে। এমনি
এক ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে'র জন্যে তারা যেন এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। আজ এই
বাদল দিনে প্রাণীরাজ্যে সবচেয়ে আনন্দে মেতেছে বুঝি ব্যাঙের দল। গোপন বাস থেকে
বেরিয়ে এসেছে তারা। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সঙ্গে তারা ঐকতান ধরেছে—গ্যাঙর গ্যাঙর গ্যাঙ।
বাইরে একটানা
বৃষ্টি। তারই মধ্যে মাঝে মাঝে আকাশে ঝলসে উঠছে বিদ্যুতের চাবুক। তা ক্ষণিকের জন্যে
যেন ফালি ফালি করে চিরে ফেলছে কালো আকাশকে। এরই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে বজ্রের গর্জন।
তারপর আবার বৃষ্টির একটানা সুর—রিমঝিম রিমঝিম।
মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় তাল কেটে গেলেও পরক্ষণেই আবার সেই সুর বাজতে থাকে।
বৃষ্টির সুর আর ক্যাসেটের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার মন গেয়ে ওঠে :
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন নেচে ওঠে।
আমার ঘরে
ক্যাসেটে একের পর এক বাজছে বর্ষার গান: 'মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ
দিগন্তে', ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর
বাদল দিনে', 'বাদল-বাউল বাজায়
যে একতারা', 'বাদল দিনের প্রথম
কদম ফুল', 'পাগলা হাওয়ায়
বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে', 'মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো'।
আজ এই বৃষ্টিমুখর
দিনে আমার বাইরে যাওয়ার তাড়া নেই। কলেজে বি. এ. অনার্সের পরীক্ষা চলছে। তাই
ক্লাস ছুটি। তা না হলে ঘরে একান্তে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান শুনতে শুনতে এই যে
বৃষ্টি উপভোগ করছি, তা পারতাম না। পারতাম
না প্রকৃতির সঙ্গে নিজের সত্তাকে মেলাতে।
আজ ঘরে বসেই
অনুভব করতে পারছি বাংলার বর্ষার রূপকে। মনের পর্দায় ঠিকই ফুটে উঠছে প্রবল বর্ষায়
শহরের রাস্তাঘাট ছয়লাপ হওয়ার ছবি। টিনের চাল, দালানের ছাদ বেয়ে বৃষ্টির পানির স্রোত নেমেছে
অলিগলিতে, রাজপথে। রাস্তার পাশের
ড্রেনগুলো উপচে উঠে রাস্তায় রাস্তায় জমে গেছে হাঁটুপানি। এরই মধ্যে বাস, কার, রিকশা, টেম্পো যেন
সাঁতার কেটে চলছে। দেখলে মনে হবে যেন উভচর যানবাহন। বড় বড় বাস পানি কেটে যাচ্ছে।
আর তার বিশাল ঢেউয়ের তলায় ডুবে যাচ্ছে রিকশার ওপরে বসা যাত্রীদের পা।
শহরের নগর জীবন
আজ নিশ্চয়ই বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। এই বর্ষার মওসুমে এই প্রথম প্রায় ১৮ ঘণ্টা
বৃষ্টি হয়েছে এক নাগাড়ে। কত বৃষ্টি হবে? ষাট মিলিমিটার? আশি মিলিমিটার?
আমার ধারণা নেই। হয়ত
সন্ধ্যায় বিটিভির খবরে তা জানা যাবে।
এ বৃষ্টিতে
নিশ্চয়ই নিচু এলাকার বাসাবাড়িগুলো পানিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। যেসব ঘরে, অফিসে ও দোকানে পানি উঠেছে তাদের বিড়ম্বনার
শেষ নেই। তারা নিশ্চয়ই বৃষ্টি নিয়ে কাব্য করছে না। বরং নিকুচি করছে ওয়াসাকে,
সরকারকে। অথচ আমার মনে
বাজছে ছেলেবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ : 'ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।' আহা আজ যদি রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা ঘর-বাড়ি,
কল-কারখানা, অফিস-আদালতে নোটিশ হিসেবে জারি করা হতো তবে
রাস্তাঘাটে বিড়ম্বনার শিকার হতে হত না। বাইরে যাঁরা তাঁরা আমার মতই ঘরে বসে
বর্ষার গান শুনতে শুনতে কল্পনার দিগন্তে উড়াল দিতে পারতেন।
আজ যাঁরা ঘরে
আটকে আছেন তাঁরা সবাই কি আমার মতো এমন করে বর্ষাকে উপভোগ করছেন? কে জানে? নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কল্পনা-বিলাসিতায় বিভোর
হয়েছেন। তবে বেশির ভাগই হয়ত নিজের নিজের মতো করে এ অলস দিনটাকে উপভোগ করছেন। কেউ
হয়ত অলস তন্দ্রায় শরীর এলিয়ে দিয়েছেন বিছানায়। কোথাও তরুণ-তরুণীর দল ঘরের
আঙিনায় কিংবা ছাদে বৃষ্টিসুখ অনুভব করছে ভিজে ভিজে। কোনো কোনো বাড়িতে হয়ত বসেছে
লুডু, তাস, দাবা কিংবা কেরাম খেলার আসর। কারো বা বাড়িতে
রান্না হচ্ছে ভুনা খিচুড়ি আর ভাজা ইলিশ। আর তার ভুর ভুর গন্ধে আশেপাশের ঘরবাড়ির
লোকজনের জিভে আসছে পানি। কোনো ঘরের বারান্দায় বসে গৃহবন্দি শিশু-কিশোররা হয়ত
ঘরের আঙিনায় জমে থাকা পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে কাগজের নৌকো—আর মনে মনে ভাবছে রূপকথায় শোনা ময়ূরপঙ্খি
নৌকার কথা। আজ সবচেয়ে কষ্ট বুঝি তাদের যারা ফুটপাতে রাত কাটায়। তারা তাদের
হাড়ি-কড়া, বিছানাপত্র নিয়ে
আপাতত মাথা গুঁজবার মতো কোনো একটা ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে কোথাও। আর যারা দিনমজুর তারা
আজ কাজহারা, বেতন হারা। তাদের
আজ কাটাতে হচ্ছে উপবাসে।
একসময় ঘড়ির
কাঁটায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। প্রকৃতিতে আজ কিন্তু তা ধরা পড়ে না। সময় যেন আজ
সকাল থেকেই থমকে দাঁড়িয়েছে। আজ সকাল-দুপুর-বিকাল সবই বুঝি একাকার হয়ে গেছে।
সারা দিনেরই আজ একই চেহারা বৃষ্টিমুখর ছায়াচ্ছন্ন কাজল-কালো।
গাঁয়ের সাধারণ মানুষ যারা সূর্যের আলো দেখে সময়ের হিসেব মেলান তাদের কাছে আজকের দিনটা কেমন যেন গোলমেলে। আজ ভরা বাদলে গ্রামের মাঠঘাট থই থই করছে বৃষ্টির পানিতে। ষদের আজ মাঠে কাজ নেই। আজ তাদের অবসর কাটছে দহলিজে বসে হুঁকো টেনে, জাল বুনে, কিংবা কারো কাছারিতে বসে পালাগান শুনে। গাঁয়ের বৌ-ঝিরাও আজ রেহাই পেয়েছে ঝাঁট দেওয়া, উঠোন লেপা, পুকুরে গিয়ে কাপড় কাঁচা, হাঁস-মুরগির তদারকির কাজ থেকে। তাদেরও আজ অবসর। এই অবসরে কেউ কেউ হয়তো বসেছে নকশি কাঁথা বোনার কাজে।
যারা কবি,
যারা ভাবুক, বৃষ্টির আঝোর কান্না হয়ত তাদের স্মৃতিতে এনেছে
অজানা বেদনা। অথবা হয়তো কবি বিভোর হয়েছেন নতুন সৃষ্টির ব্যাকুলতায়। এমন দিনে
তারা পাড়ি জমান ভাবের জগতে, পাখা মেলেন
কল্পনার রাজ্যে। এমনি বৃষ্টির দিনে আবহমান কাল ধরে এই কবিরা কত কবিতাই না লিখেছেন!
পদাবলির কবি এমন বর্ষার পটভূমিতে ফুটিয়ে তুলেছেন রাধার বিরহ বেদনা—
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
আর রবীন্দ্রনাথ
এমন দিনে অনুভব করেছেন মনের গোপন কথাটি প্রকাশের ব্যাকুলতা—
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
কিন্তু বিশ শতকের
আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসু বর্ষাকে দেখেছেন দৈনন্দিন বাস্তবতায় :
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ, কেরানি গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলে বর্ষা, ইলিশ উৎসব।
এমনি কত কথা মনে পড়ছে আজ, এই বাদল দিনে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আজ মিশে গেছে মনের নীরব অনুভূতি, নীরব শব্দ । মিশে গেছে কবিতা ও গান। সেখানে আনন্দ ও বেদনা, বাস্তবতা ও কল্পনা, কথা ও সুর সবই একাকার হয়ে যায়।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ বাদল দিনে - প্রবন্ধ রচনা
শিক্ষার্থীরা আজকে আমরা জানলাম বাদল দিনে - প্রবন্ধ রচনা সম্পর্কে । যদি আজকের এই বাদল দিনে - প্রবন্ধ রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD
Post a Comment