যখন সন্ধ্যা নামে
সন্ধ্যা হলো
সূর্যাস্তের ক্ষণ, গোধূলি-লগ্ন।
দিনের শেষ আর রাতের শুরুর এক মায়াবী সন্ধিক্ষণ সন্ধ্যা। সন্ধ্যা জানান দেয়,
জীবন-পরিক্রমায় একটি
দিনের শেষ হলো, এল রাত্রি। তাই
সন্ধ্যা দিন আর রাতের মাঝামাঝি সময়ের এক অপরূপ রূপ।
জগৎকে আপনার
ছায়ালোকে ঘিরে শান্ত সন্ধ্যা ধীর পায়ে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। কাননে বনে
সন্ধ্যামালতীরা ফুটে ওঠে, পাখিরা আকুল স্বরে
সম্ভাষণ জানায় সন্ধ্যাকে। স্বভাবের কোমলতায় স্নেহময়ী মায়ের মতো সন্ধ্যা এসে
দাঁড়ায় প্রকৃতির দুয়ারে । জগৎ যেন এতক্ষণে হয়ে ওঠে পূর্ণ।
কবি জীবনানন্দ
দাশ লিখেছিলেন, 'দিনের ক্লান্তির
শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে।' নিঃশব্দ ছায়াময়ী সন্ধ্যার আবির্ভাবে প্রকৃতিকে মনে হয় ছায়াপুরী। চারপাশের
রঙ পাল্টে যায়। মানুষের সারাদিন কাটে কর্মমুখরতায়। সন্ধ্যায় এর অবসান ঘটে।
বিশ্রামের জন্যে ঘরে ফেরে মানুষ। প্রকৃতিতে তখন শুরু হয় আলোছায়ার এক অপূর্ব
খেলা। গাছের মাথায়, পাহাড়ের চূড়ায়
বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। পাখিরা দিনের বিচরণ সেরে
ফিরে আসে আপন আপন নীড়ে। পাখায় তাদের সূর্যের স্বর্ণরেখা। পরম মমতায় সন্ধ্যা
তাদের নীড়ে ফেরার আমন্ত্রণ জানায়। শান্তিময় সন্ধ্যায় সব কোলাহল যায় থেমে।
রৌদ্রোজ্জ্বল দিন তার সমাপনী গান গেয়ে লুটিয়ে পড়ে সন্ধ্যা মায়ের কোলে। গানের
শেষ তানটুকুও লীনপ্রায়। কবি সন্ধ্যাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন এভাবে—
দিনের আলোক রেখা মিলিয়েছে দূরে
নেমে আসে সন্ধ্যা ধরণীর পুরে।
তিমির ফেলেছে ছায়া
ঘিরে আসে কাল মায়া
প্রান্তর কানন গিরি পল্লি বাট-মাঠ
অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ বিরাট।
সন্ধ্যা নীরব,
গম্ভীর। নীরবতাই তার
ভাষা। শব্দাড়ম্বরহীন সে ভাষা ভাবে পূর্ণ। সন্ধ্যার নয়নের কোণে, অধর রেখায়, বিকশিত মুখ লাবণ্যে তার বিকাশ, সে আবেগময় মর্মস্পর্শী গম্ভীর ভাব কি শব্দের
ভাষায় প্রকাশ করা যায়! প্রভাব কোথাও অস্ফুট, কোথাও অর্ধস্ফুট। এর পরিপূর্ণ প্রভাব পড়ে কেবল
ভাবুক হৃদয়ে। সন্ধ্যায় সুখের তীব্রতা মুছে গিয়ে দুঃখের আনন্দের মতো মধুর
স্নিগ্ধ ভাব থাকে। সুখের তীব্রতায় কোনো গভীরতা নেই। সন্ধ্যার বিষণ্নতায় গভীরতা
আছে। তাই সন্ধ্যা তীব্র সুখের কাছাকাছি নয়। সন্ধ্যা যেমন ধীর পায়ে সুদূর
মায়াপুরী হতে নেমে আসে, আমাদের হৃদয়ও
তেমনি নীরবে, মনের অজান্তেই
সান্ধ্য ভাবাচ্ছন্ন হয়ে আসে।
সন্ধ্যা
প্রকৃতিতে নামে আপন নিয়মে। বিচিত্ররূপে ধরা দেয় শহর বা গ্রামের পরিবেশে। সবুজ
শ্যামল গাঁয়ে বিদায়ী রক্তিম সূর্য এক অপরূপ সোনালি আভা ছড়িয়ে দেয়। আকাশ
যেখানে মাটির সাথে এক হয়ে মেশে সেদিকে চোখ তুলে তাকালে মনে হয়, এ জগৎ বড় অচেনা। ক্লান্ত রাখাল মাঠ থেকে গরুর
পাল নিয়ে বাড়ির পানে ছোটে। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে ফসল বোঝাই
গরুর গাড়ি। হাটুরে ফেরে হাট থেকে। ফসলের বোঝা মাথায় নিয়ে ফেরে কোনো কৃষক। সব
পাখি ঘরে ফেরে। শান্ত নদীর জলে অপস্রিয়মাণ সূর্যের রক্তিম আভা। শান্ত গৃহকোণ,
ছায়াময় নিকোনো উঠোন
স্তব্ধ, অচঞ্চল। সব যেন
ছবির ফ্রেমে গাঁথা। এই রূপময়তা মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের
‘সন্ধ্যা’ কবিতাখানি--
হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে সুপ্তপ্রায় গ্রাম।
পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে,
শিশুরা খেলে না;
শূন্য মাঠ জনহীন;
ঘরে-ফেরা শ্রান্ত
গাভী গুটি দুই-তিন
কুটির-অঙ্গনে বাঁধা, ছবির মতনস্তব্ধপ্রায়।
গৃহকার্য হলো সমাপন— কে ওই
গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি
সম্মুখে দেখিছে চাহি, ভাবিছে কী জানি
ধূসর সন্ধ্যায়।
শহরে সন্ধ্যায়
নির্জনতার অবকাশ নেই। সন্ধ্যা নামার আগেই পথে পথে জ্বলে ওঠে সড়কবাতি। ঘরবাড়ি আর
দোকানপাট ঝলমল করে উজ্জ্বল আলোয়। সে আলোয় হারিয়ে যায় গোধূলি বেলার আভা।
যান্ত্রিক সভ্যতায় চাপা পড়ে যায় নীড়ে ফেরা পাখির কলকাকলি। সন্ধ্যার শান্ত,
ধীর, অচঞ্চল রূপটি শহরে উপলব্ধি করা যায় না বললেই
চলে। তবু সব কোলাহল থেকে দূরে সরে গভীরভাবে প্রকৃতির সাথে একাকার হলেই উপলব্ধি করা
যায় সেই ক্ষণ। শ্রান্তি, শান্তি আর
সন্ধ্যার অন্ধকার একাকার হয়ে দিবসের প্রখরতার অবসানে এনে দেয় প্রশান্ত ভাব।
সারাদিন জ্বলে জ্বলে সূর্য এখন ক্লান্ত । শেষ বিকেলে আলোটুকু মিলিয়ে যেতে না
যেতেই আকাশে মিটমিট করে জ্বলে সন্ধ্যাতারা। সন্ধ্যার কোলের কাছে পরম আবেগে জগৎ ধরা
দেয়। মৃদু শান্ত হেসে সন্ধ্যা তাকে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়। ক্ষণিকের জন্যে সব
যেন হয়ে যায় স্থির। স্নেহের সুগভীর আকর্ষণের কাছে জগৎ ধরা দেয় সন্তানের মতো।
সূর্য ডুবে যাবার পরও পশ্চিম আকাশে লাল আলোর রেশ রেখে যায়। সুউচ্চ দালানের শীর্ষে
পড়ে সেই আলোর রেখা। সন্ধ্যার রূপমুগ্ধতায় অনেক লোকের মাঝেও নিজেকে একাকী মনে
হয়।
যখন সন্ধ্যা নামে
তখন মনে হয় যেন পৃথিবী জ্যোতির অলংকার পরেছে। পেছনে ফেলে আসা দিনকে মনে হয় অতি
প্রবীণ, প্রাচীন আর বিষয়ী।
দিনশেষে যে সন্ধ্যা আসে তাকে মনে হয় যেন অচেনা।
সন্ধ্যা
খানিকক্ষণের জন্যে এসেই যাবার প্রস্তুতি নেয়। তাকে যে না গেলে চলবে না। কেননা
যেখানে সে যাবে কেবল সেখানেই প্রেম জাগবে, স্নিগ্ধতা জাগবে। তাই সন্ধ্যা যেমন ধীর পায়ে এসেছিল তেমনি ধীর পায়ে চলে
যায়। সন্ধ্যাতারা আকুল নয়নে বিদায় জানাতে আসে সন্ধ্যাকে।
সন্ধ্যা যায়—আলোকধৌত রজত ছায়াপথ দিয়ে একাকিনী চলে যায়।
কোমল আর গম্ভীরে, উজ্জ্বল আর মানে
তার সৌন্দর্য এমন পূর্ণতা ব্যক্ত করে যার কোনো তুলনা মেলে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যার বিদায়’ কবিতায় ধরা পড়েছে সন্ধ্যার বিদায়ের সেই
রূপটুকু—
সন্ধ্যা যায়, সন্ধ্যা ফিরে চায়, শিথিল কবরী পড়ে খুলে—
যেতে যেতে কনক-আঁচল বেঁধে যায় বকুলকাননে,
চরণের পরশরাঙিমা রেখে যায় যমুনার কূলে-
নীরবে বিদায়-চাওয়া চোখে, গ্রন্থি-বাঁধা রক্তিম দুকূলে
আঁধারের মানবঁধুয়ায় বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল
নয়নে।
সন্ধ্যা চলে
গেলেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই ভাবটি থেকে যায়। একসময় সে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে
উপহার দিয়ে যায় রাত্রি। এই রাতের শান্ত মধুর রূপটি মানুষের জন্যে নিয়ে আসে পরম
শান্তি।
[ অনূরূপ রচনা : নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, যখন সূর্য অস্ত যায়।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ যখন সন্ধ্যা নামে - প্রবন্ধ রচনা
শিক্ষার্থীরা আজকে আমরা জানলাম যখন সন্ধ্যা নামে - প্রবন্ধ রচনা সম্পর্কে । যদি আজকের এই যখন সন্ধ্যা নামে - প্রবন্ধ রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD
Post a Comment