এই কৃষিকাজে বিজ্ঞান রচনাটি যেকোন ক্লাসের জন্য। যারা ক্লাস ৭ম শ্রেনীতে আছে তাদের জন্যও এই কৃষিকাজে বিজ্ঞান রচনাটি। আবার ক্লাস দশম শ্রেনীতে আছো তাদের জন্য এই কৃষিকাজে বিজ্ঞান রচনা। অর্থাৎ ক্লাস ৭ম শ্রেনী থেকে ১০ম দশম শ্রেনী পর্যন্ত সবার প্রযোজ্য এই কৃষিকাজে বিজ্ঞান রচনা। রচনাটি পড়ার আগে তোমরা অনুচ্ছেদ রচনালেখার নিয়ম ও সুচিপত্রটি দেখা নাও।
কৃষিকাজে বিজ্ঞান
সূচনা: বিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রে
মানুষকে দিয়েছে বিপুল শক্তি ও সাফল্য। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ মানবজীবনকে করেছে
গতিময় বিশাল এ পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই
কল্যাণপ্রভাব বিস্তৃত হয়েছে কৃষিক্ষেত্রেও।
মানব জীবনে কৃষির গুরুত্ব: মানুষের
অস্তিত্বের সাথে কৃষি সরাসরি জড়িত। মানুষের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা হলো অন্ন।
আর এই অন্ন উৎপাদন সম্পর্কিত কাজই মূলত কৃষিকাজ। কৃষিকাজ মানুষের আদিমতম জীবিকা।
বর্তমান যুগেও কৃষিই অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি ও
স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে দেশের সার্বিক উন্নতি
কৃষির প্রাচীন প্রেক্ষাপট: আদিমকালে
মানুষ খাদ্যের জন্যে প্রধানত নির্ভর করত বন্য পশুপাখি, ফলমূল
ও মাছের ওপর।সে সময় তারা খাবারের জন্যে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রায়ই তারা
খাদ্য সংকটে ভুগত। খাবারের অধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিও কম হতো না।
কালক্রমে কৌতূহলী মানুষ নিজের প্রয়োজনেই বীজ বপন ও ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য
উৎপাদন করতে শেখে। এভাবেই মানব ইতিহাসে কৃষি ও কৃষক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে
কৃষির
পূর্ব অবস্থা: কৃষকেরা
গরু,
ঘোড়া, মোষ
ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর সাহায্যে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করত। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করত
তাদের ফলনের পরিমাণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল কৃষির মূল বাধা। এ ছাড়া বার বার চাষের
ফলে উন্নত জমির উর্বরতা হ্রাস, উন্নত বীজের অভাবে ভালো ফলন না হওয়াও ছিল
বিরাট সমস্যা। এ সময় কৃষকরা পানি সেচ দিত সেঁউতি দিয়ে, ফসল
কাটত কাস্তে দিয়ে,
ধান
মাড়াই করত পিটিয়ে,
মাঠ
পরিষ্কার করত কাস্তে,লাঙল, দা
দিয়ে,
ফসল
শুকাত রোদে ছড়িয়ে দিয়ে। প্রতিটি পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সময় ও শ্রম সাপেক্ষ। এসব
সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে কৃষকের ফসল পাওয়াটা ছিল ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ।
কৃষির আধুনিকায়নে বিজ্ঞান: মাত্র
২০০ বছর আগে থেকে কৃষির আধুনিকায়নের সূচনা হয়। কৃষিক্ষেত্রে আসে উন্নতযন্ত্রপাতি
ও বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতি। বর্তমানে কাঠের লাঙলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে কলের লাঙল, ট্রাক্টর, পাওয়ার
টিলার ও হাইড্রোটিলার। শস্যকাটা, ঘাসকাটা ও ধান মাড়াইয়ের কাজে এখন ব্যবহৃত
হচ্ছে নানা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি। আধুনিক যন্ত্রগুলো সরাসরি বিদ্যুৎ, পেট্রোল, ডিজেল
ইত্যাদি জ্বালানির সাহায্যে চলে। ফলে কৃষিক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের প্রয়োজন কমে
এসেছে অনেকাংশেই। অতিবৃষ্টিও আজ কৃষকের ভয়ের কারণ নয়। বিজ্ঞানের কল্যাণে
অনাবৃষ্টি অঞ্চলেও চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের ফলে
কৃষিক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি উচ্চ
ফলনশীল বীজ উৎপাদনের সাফল্য অভাবনীয়। বিজ্ঞানের বদৌলতে বিশ্বের মরু অঞ্চলগুলোতেও
চাষাবাদ করা শুরু হয়েছে। এভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক
পরিবর্তন এনেছে।
কৃষির বিভিন্ন শাখায় বিজ্ঞান: কৃষিক্ষেত্রে
বিজ্ঞানের আশীর্বাদে ফসলের ক্ষেত্রগুলো আজ পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতিতে পরিচালিত উন্নত খামারগুলো আজ বিস্ময়কর পরিমাণে দুধ, মাংস, ডিম
ইত্যাদি উৎপাদন করছে এবং বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে। মৌমাছি এবং
মৎস্য পালনেও বিজ্ঞান অসাধারণ উন্নতি সাধন করেছে । ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে জিন
প্রযুক্তির ব্যবহার অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কৃষি ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশের
মাটি ও জলবায়ু কৃষিকাজের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু উন্নত বিশ্বের সাথে তাল
মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত বিপ্লব হয়নি। তবে
বর্তমানে অল্প হলেও বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে গবেষণা চলছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও
এসেছে। গবেষণার জন্যে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট,
বাংলাদেশ
পরমাণু কৃষি ইনস্টিটিউট ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। কিন্তু বাংলাদেশের
কৃষকদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে চলেছে। এ অবস্থার
উন্নয়নে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক।
কৃষিতে বর্তমান প্রেক্ষাপট : আধুনিক
যুগ মূলত বিজ্ঞানের যুগ এবং মানুষ এ বিজ্ঞানের সহায়তায় জীবনের সর্বস্তরে ও
সর্বাবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে। বিজ্ঞান বলে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করে তার
বিপুল সম্পদ নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে
উন্নতির নতুন স্তরে নিয়ে মানুষকে পশু স্তর থেকে উন্নীত করে পরিণত করেছে সভ্য
মানুষে। সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে দ্রুততর করে ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তের ব্যবধান।
ফলে মানুষ প্রকৃতিকে করেছে আজ্ঞাবাহী। আর এই বিজ্ঞানই আজ তার সুদূরপ্রসারী
কল্যাণময়ী হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে।
কৃষির আধুনিকায়নে বিজ্ঞান : খাদ্যের
জন্য মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল বলেই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কৃষির আদিম স্তর
কাটিয়ে আধুনিক স্তরে পৌঁছেছে। আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে
শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিতে আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে। ফলে কৃষকেরা প্রাচীন চাষ
পদ্ধতিকে পরিহার করে উন্নত পদ্ধতির লাঙল, ট্রাক্টর, পাওয়ার
টিলার,
বিদ্যুৎচালিত, পাম্পের
সাহায্যে সেচব্যবস্থা প্রয়োগ করে কৃষিক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন সাধন করছে। শুধু
সেচব্যবস্থাই নয় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে অকল্পনীয় অগ্রগতি এনেছ
বিজ্ঞান । উন্নতমানের বীজ উৎপাদনেও বিজ্ঞান বিস্ময়কর অবদান রাখছে। বিশেষ করে
কৃত্রিম উপায়ে উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদনের সাফল্যের মধ্যদিয়ে প্রমাণ করেছে সাধারণ
বীজের তুলনায় এসব বীজ তুলনামূলকভাবে ফসল উৎপাদনে সময় কম লাগে এবং ফলনও বেশি হয়।
সাথে শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায় উন্নত বীজকে আরও শক্তিশালী করেছে।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বের শুষ্ক-মরু অঞ্চলে চাষাবাদের প্রচেষ্টাও করছে বিজ্ঞান।
এমনকি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এক ঋতুর ফসল আর এক ঋতুতে উৎপাদন করাও সম্ভব হচ্ছে।
অনেক গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কৃত্রিম ঘরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শীতকালীন
শাক-সবজির চাষ হচ্ছে।
উন্নত দেশে কৃষিকার্যে বিজ্ঞান: জমি
কর্ষণ,
বীজবপন, সেচকার্য, ফসল
কাটা,
মাড়াই, বাছাই
ইত্যাদি সব কাজ আজ উন্নত দেশসমূহের কৃষকেরা যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করছে।
বপনযোগ্য সংরক্ষিত বীজও বাছাই করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। এ ছাড়া জমিতে সার দেয়া
এবং ফসলের আক্রমণকারী পোকামাকড় দমনের জন্য ওষুধ ছিটানোর কাজও যন্ত্রের সাহায্যে করে
থাকে ৷ জমিতে সেচের জন্য গভীর, অগভীর নলকূপের ব্যবস্থাসহ পাম্পের ব্যবস্থাও
বিজ্ঞান করেছে। ফসল কাটার যন্ত্রের সাহায্যে ফসল কাটা থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই
হয়ে শস্য ও খড় আলাদা হয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশের কৃষকেরা কৃষিকার্যকে মূলত
যন্ত্রনির্ভর করে তুলেছে। এসব কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশেষ কতকগুলো যন্ত্রপাতি । যেমন
: মোয়ার (শস্য ছেদনকারী যন্ত্র), রূপার (ফসল কাটার যন্ত্র), বাইন্ডার
(ফসল বাঁধার যন্ত্র),
থেশিং
মেশিন (মাড়াই যন্ত্র),
ম্যানিউর
স্প্রেডার (সার ছিটানোর যন্ত্র) ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া
প্রভৃতি দেশের খামারে ১০০ একর পর্যন্ত জমি চাষ হচ্ছে কেবল একটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে
। সেগুলো আবার একসাথে তিন চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একত্রে কাজে লাগাতে সক্ষম।
অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবেলার উপযোগী অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে
উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞান সদা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের কৃষিকার্যে বিজ্ঞান : মাটি, পানি, মানব
সম্পদে প্রভৃতি বাংলাদেশের যেমন শ্রেষ্ঠ সম্পদ তেমনি এ সম্পদগুলো সর্বোত্তম
সমন্বিত ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি
। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, মাঠে-প্রান্তরে
যে কৃষিদ্রব্য উৎপন্ন হয় তার সাথে সমগ্র দেশবাসী ভাগ্য জড়িত । ৮০% লোকই যে দেশে
কৃষিজীবী সে দেশের অর্থনীতিক বুনিয়াদ নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবেই কৃষির ওপর।
যান্ত্রিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগেও এদেশের কৃষকরা এখনও পড়ে রয়েছে মান্ধাতার
আমলের চাষ পদ্ধতির ওপর। সেই একজোড়া শীর্ণ কঙ্কালসার বলদের পেছনে শীর্ণতর
হাড্ডিসার কৃষকের চেপে ধরা প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগের কাঠের লাঙল। তবে আশার কথা
এই যে,
কিছু
কিছু ক্ষেত্রে এদেশেও কৃষিকার্যে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে জমির
বিখণ্ডীকরণের কারণে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সকল ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না।
সমতল ভূমিতে ট্রাক্টর চালানো সম্ভব হচ্ছে। এখন চাষীরা বৃষ্টির ওপর নির্ভর না করে
সেচের জন্য উন্নতমানের বীজ। অতএব বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ পদ্ধতি দেশের চাষাবাদে
সঠিকরূপে প্রয়োগ করতে পারলে অচিরেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে।
বর্তমান চাষ পদ্ধতি : বর্তমানে ক্ষেত-খামারে
উন্নতমানের বীজ ব্যবহারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক
গবেষণার ফলে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। বাংলাদেশে কৃষি-গবেষণা ইনস্টিটিউট
ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল শস্যের বীজ উদ্ভাবনেও সফলকাম হয়েছে। পাট, ধান, তুলা
ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের জন্যও প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিয়িনত গবেষনা পরিচালিত হচ্ছে এবং কৃষিকাজে বিজ্ঞানের
অবদানকে নিশ্চিত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসছে।
সার প্রয়োগ : স্মরণাতীতকাল হতে শস্য
উৎপাদনের ফলে জমির স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ খাদ্যাভাবে
মৃত্যুর কবলে পতিত হতো। কিন্তু বিজ্ঞান রাসায়নিক সার উদ্ভাবনের ফলে কৃষিতে
সামান্য হলেও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে ততটুকু বৃদ্ধি
বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। এখনও প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষ না খেয়ে
মারা যাচ্ছে। তবুও আমরা ক্রমাগত বিজ্ঞানিক পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং অল্প
হলেও উন্নয়নের স্বাদ অনুভব করছি।
কীট পতঙ্গ দমন : বিজ্ঞান আমাদেরকে
পঙ্গপালের দৌরাত্মের হাত হতে উৎপাদিত ফসল রক্ষায় সাহায্য করছে। কীট পতঙ্গ ধ্বংস
করার জন্য বিজ্ঞান কীটনাশক ওষুধ উপহার দিয়েছে আমাদেরকে।কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের
অবদান অপরিমেয় : বিজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, বিজ্ঞানিক আবিষ্কারের
সাহায্যে শস্য রক্ষা করে আমরা খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বহুলাংশে
বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। ফলে উদ্বেগজনক হারে না খেয়ে মরার সংকটাপন্ন অবস্থার হাত
হতে অব্যাহতি পেয়েছি।
কৃষি গবেষণা বিজ্ঞান : কৃষি
গবেষণার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। কারণ কৃষিজাত দ্রব্যের বা পণ্যের ব্যবহার
ও নতুন ধরনের বীজ উদ্ভাবন,
অপ্রচলিত
কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার সংক্রান্ত বিজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশ
ও আবহাওয়া দুষণের সাথে সম্পর্ক নির্মাণ করে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগ সার ও
কীটনাশক প্রভৃতির প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের কৃষিকার্যে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও আমাদের
করণীয় : মান্ধাতার
আমলের কাঠের লাঙলকে বিদায় জানিয়ে কৃষকের হাতে বিজ্ঞানের তৈরি হাতিয়ার তুলে দিতে
হবে এবং সেই সাথে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য ব্যবস্থার
সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে
দিতে হবে। বিজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে
তুলতে হবে। আমাদের দেশে কৃষকগণ অশিক্ষিত হওয়ায় আধুনিক'কৃষি
ব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ। কৃষক সম্প্রদায়কে কৃষি -বিশেষজ্ঞ ও কৃষি-কর্মকর্তাদের
সক্রিয় সহযোগিতায় আধুনিক কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কৃষিকাজের
আধূনিকায়নের জন্য কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এ ছাড়া
গ্রামীণ জীবনে চিকিৎসা,
বিদ্যুৎ
ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গ্রামের প্রতি শিক্ষিত লোকের আকর্ষণ বৃদ্ধি করার
মাধ্যমেও কৃষিজীবনের উন্নতি করা সম্ভব।
কৃষির আধুনিকায়নে বিজ্ঞান : মানুষ
খাদ্যের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানের প্রভাবে কৃষিকার্য আদিম স্তর কাটিয়ে
আধুনিক স্তরে পৌঁছেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে
শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে। ফলে কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে
উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি নির্ভর কৃষিপদ্ধতির সাথে পরিচিত হতে থাকে। কাঠের লাঙেেলর
পরিবর্তে কৃষকের হাতে আসে কলের লাঙল, ট্রাক্টর, পাওয়ার
টিলার এবং সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ চালিত পাম্প। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম
বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। উন্নতমানের
বীজ উৎপাদনেও বিজ্ঞান বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে কৃত্রিম উপায়ে উচ্চ
ফলনশীল বীজ উৎপাদনের সাফল্য ভাবনার অতীত। এসব বীজ সাধারণ বীজের তুলনায় ফসল
উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম লাগায়, তাতে ফলনও বেশি হয়।
পাশাপাশি শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য
এসেছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের শুষ্ক মরুঅঞ্চলে চাষাবাদ শুরু করার প্রচেষ্টা
চালাচ্ছে কৃষিবিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শীত ঋতুর ফসল, শাকসবজি
অন্য যেকোনো ঋতুতে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের দানে । আবার গ্রীষ্মপ্রধান
দেশে বর্তমানে কৃত্রিম ঘরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে শীতকালীন শাকসবজির চাষ হচ্ছে।
উন্নত দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান : উন্নত
দেশসমূহে কৃষিকার্য সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল । জমি চাষ, বীজ
বপন,
সেচকার্য, ফসল
কাটা,
ফসল
মাড়াই এবং ফসল বাছাই ইত্যাদি সব কাজ আজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয়। বীজ
বপনের আগে বীজ বাছাই-এর কাজও যন্ত্রের সাহায্যে করে থাকে। জমিতে প্রয়োজনমত সার
প্রয়োগ,
কীটনাশক
ছিটিয়ে পোকা দমনের কাজও যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করা হয়। বৃষ্টির অপেক্ষায় না
থেকে গভীর নলকূপ এবং পাম্পের সাহায্যে ফসলের জমিতে সেচ দিয়ে থাকে। ফসল কাটার
যন্ত্রের সাহায্যে ফসল কাটা, ফসল মাড়াই হয়ে শস্য ও খড় আলাদা করা যায়।
এক কথায় উন্নত বিশ্বের কৃষকেরা কৃষিকার্যকে যন্ত্রনির্ভর করে ফেলেছে বিজ্ঞানের
দান। এসব কাজে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে :
মোয়ার (শস্য ছেদনকারী যন্ত্র), রপার (ফসল কাটার থেশিং মেশিন (মাড়াই
যন্ত্র),
ম্যানিউর
স্প্রেডার (সার ছিটানোর যন্ত্র) ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, র
যন্ত্র),
বাইণ্ডার
(ফসল বাঁধার যন্ত্র),
অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া
প্রভৃতি দেশের খামারে একদিনে ১০০ একর পর্যন্ত জমি চাষ হচ্ছে কেবল এক-একটি
ট্রাক্টরের মাধ্যমে। এই ট্রাক্টরগুলো এক সাথে তিন চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একত্রে
কাজে লাগাতে সক্ষম। তারা বিভিন্নভাবে কৃষিকাজের এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে
যার ফলে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অগ্রগামী।
বাংলাদেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান : মাটি, পানি
ও মানবসম্পদ হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ তিন সম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত
ব্যবহারের ওপরেই নির্ভর করছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি।
সুজলা,
সুফলা, শস্য-শ্যামলা
বাংলাদেশের মাঠে-প্রান্তরে যে কৃষিদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তার
সাথে দেশবাসীর ভাগ্য জড়িত । কারণ বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। শতকরা ৮০ জন লোকই
কৃষিজীবি এবং এদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সম্পূর্ণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব যখন
যান্ত্রিক কলাকৌশলের সাহায্যে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক
দূরে তখনও বাংলাদেশ পড়ে আছে মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যর্থ প্রচেষ্টার
মাঝে। এখনও সেই করুণ ছবি,
একজোড়া
শীর্ণ কঙ্কালসার বলদের পেছনে শীর্ণতর হাড্ডিসার কৃষক চেপে ধরে আছে প্রাগৈতিহাসিক
প্রস্তরযুগের কাঠের লাঙ্গল। তবে আশার কথা এই যে, ক্ষেত্র বিশেষে বর্তমানে
আমাদের দেশেওকৃষিকাজে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
বিখণ্ডিত জমির কারণে ব্যাপকভাবে জমি কর্ষণে ট্রাক্টর ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। সমতল
ভূমিতে ট্রাক্টর ব্যবহার সহজেই করা হয়ে থাকে । এখনও দেশের চাষীরা বৃষ্টির ওপর
নির্ভর করলেও অধিকাংশই ব্যবহার করছে সেচের জন্য গভীর নলকূপ এবং মেশিনচালিত পাম্প।
অধিক ফসলের জন্য এখন কৃষকেরা উন্নত বীজ বপন করছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই উন্নত বীজ
ব্যবহৃত হচ্ছে না। তাই বিজ্ঞানের অবদানকে দেশের চাষাবাদের ক্ষেত্রে সঠিকরূপে, ব্যাপকভাবে
ব্যবহার উপযোগী করতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অচিরেই উন্নীত করতে পারব।
বাংলাদেশের কৃষকের বাস্তব অবস্থা : বিজ্ঞানের
অবদান বাঙালি কৃষকদেরকে প্রভাবিত করলেও এখনও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে
পারেনি। কারণ এখনও কৃষকেরা চৈত্রের প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে, বর্ষার
অবিরাম বর্ষণ মাথায় নিয়ে,
শীতের
প্রচণ্ডতা সহ্য করে দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতের মধ্যে থেকেও মাটির কঠিন বুক ভেদ করে
ফসল ফলিয়ে ঘরে এনে সকলের ক্ষুধা নিবৃত্ত করছে। তাই বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক কৃষি
যন্ত্রপাতি ও কৃষিজাত দ্রব্যাদির অধিক ব্যবহার ও সরবরাহ করে কৃষকদেরকে আধুনিক
জীবনে টেনে আনতে হবে। এজন্য দরকার ব্যাপক হারে প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি
করা এবং সুলভমূল্যে কৃষিজাত যন্ত্র ও দ্রব্যাদি সরবরাহ করা।
দেশের কল্যাণে বিজ্ঞান : অধিক
জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জমির পরিমাণ কম। স্বল্প পরিমাণ জমিতে অধিক ফসল
ফলিয়ে জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার
অপরিহার্য। কারণ দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফসলি জমি কমে যাচ্ছে, সেই
সাথে জমির উর্বরতাও কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে ফসল ফলানো
ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
বর্তমান চাষ পদ্ধতি : বর্তমানে
খেতে খামারে উন্নতমানের বীজ ব্যবহারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে কৃষি
গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল শস্যের বীজ উদ্ভাবনেও
সফলকাম
হয়েছে।
পাট,
ধান, তুলা
ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের জন্যও প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অহরহ গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও কৃষিকাজে বিজ্ঞানের
অবদানকে নিশ্চিত করার কাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এসেছেন।
সার প্রয়োগ : জমির উৎপাদিকা শক্তি
হ্রাস পাওয়ার ফলে খাদ্যের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে খাদ্যাভাবে মানুষ
মারাও যাচ্ছে। কিন্তু রাসায়নিক সার উদ্ভাবনের ফলে কৃষিভূমিতে সারের ব্যবহার বহুল
পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খাদ্য ঘাটতিও কমে আসছে।
কীটপতঙ্গ দমন : বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমরা
পঙ্গপালের দৌরাত্ম্যের হাত হতে উৎপাদিত ফসল রক্ষায় সফল হয়েছি। কারণ বিজ্ঞান
কীট-পতঙ্গ ধ্বংস করার যন্ত্র হিসেবে বিভিন্ন কীটনাশক ওষুধ উপহার দিয়েছে।
বাংলাদেশের
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও আমাদের করণীয় : কাঠের
লাঙলকে বিদায় জানিয়ে কৃষকের হাতে বিজ্ঞানের হাতিয়ার তুলে দিতে হবে। সাথে
আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
পদক্ষেপ হলো :
- কৃষক
সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে।
- বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতিতে চাষাবাদের ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে।
- আমাদের কৃষকগণ অশিক্ষিত হওয়ায়
আধুনিক কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে।
- কৃষি
বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় কৃষক সম্প্রদায়কে কৃষি
ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
- কৃষিকাজের আধুনিকায়নের জন্য
কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।
- গ্রামীণ জীবনে চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
দিয়ে গ্রামের প্রতি শিক্ষিত লোকের আকর্ষণ বৃদ্ধি করার মাধ্যমেও কৃষিজীবনের
উন্নতি করা সম্ভব।
সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ : আদিম
সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত কৃষির চাহিদা টিকে রয়েছে বেঁচে থাকার
প্রয়োজনে। তখন বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। শুরুতে তারা
গরু,
মহিষ, ঘোড়া, লাঙল
ইত্যাদির মাধ্যমে জমি চাষ করত। কিন্তু পরিবর্তনশীল আবহাওয়া যখন রূদ্রমূর্তি ধারণ
করে কখনো অতিবৃষ্টি আবার কখনো প্রচুর খরা দেখা দিত, তখন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হতো
এবং উৎপাদন কমে যেত। প্রকৃতির ওপর মানুষের কোনো প্রভাব না থাকায় তারা ছিল
প্রকৃতির কাছে নিরুপায়। বিজ্ঞান সনাতন এসব পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের উদ্ভাবন : মানুষের
খাদ্যের জোগান হয় কৃষি থেকে। কৃষিকাজে উন্নতি সাধন করা গেলে খাদ্যের জোগান
সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে
বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে
শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিতে আধুনিকতার সূচনা ঘটে। তখন থেকে কৃষকরা লাঙল-জোয়াল, গরু-মহিষের
পরিবর্তে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে কৃষিকাজ আরম্ভ করে। সেচ ব্যবস্থায়
প্রাকৃতিক বৃষ্টিনির্ভরতার বিপরীতে গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়া ও
কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর যন্ত্রের মাধ্যমে এ কাজ সম্পন্ন হতে থাকে। উন্নত বীজ
উৎপাদন ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এর মান নিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞানেরই সাফল্য। এছাড়া বিভিন্ন
রাসায়নিক সার আবিষ্কারের ফলে ফসলের ক্ষতিসাধন রোধ বিজ্ঞানের কল্যাণেই সম্ভব
হয়েছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রভাব : বিজ্ঞানের
আবিষ্কারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কমেছে
পরনির্ভরশীলতা। কৃষিকাজ সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় শ্রমশক্তি যেমন কম লাগছে
তেমনি সময় অপচয় রোধ হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে শীতপ্রধান দেশে তাপ নিয়ন্ত্রণ
করে শাকসবজি ও ফলমূল ঘরেই উৎপাদন করা যাচ্ছে। মরুভূমির দেশে বালি সরিয়ে সেখানে
মাটি ফেলে সেচের মাধ্যমে ফসল চাষ করা হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে জমির উর্বরতা কম থাকা
সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ফলে অনেক বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
আধুনিক যন্ত্রপাতি : কৃষিতে
বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার মানুষের সময় ও শ্রম বাঁচিয়েছে
বহুগুণে । সহজতর হয়েছে কৃষিব্যবস্থা। কৃষিকাজে বিজ্ঞান যেসব যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন
করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যহলো: শস্য ছেদনকারী যন্ত্র— মোয়ার, ফসল কাটার যন্ত্র— রুপার, ফসল বাঁধার যন্ত্র— বাইন্ডার, মাড়াইয়ের যন্ত্র— থ্রেশিং মেশিন,
সার
বিস্তারণ যন্ত্র— ম্যানিউর স্প্রেডার,
চাষাবাদ
করার যন্ত্র— ট্রাক্টরসহ আরও অসংখ্য যন্ত্রপাতি 1 আধুনিক
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কম্পিউটারের ব্যবহারও কৃষিকাজে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষিকাজে বিজ্ঞান : আমাদের
দেশে কৃষিকাজকে এখনো নিম্নমানের পেশা হিসেবে দেখা হয়। অথচ বাংলাদেশ একটি
কৃষিনির্ভর দেশ। এখানকার জমির উর্বরাশক্তি অন্য দেশের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। কিন্তু
সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে এদেশের কৃষিকাজে এখনো তেমন
পরিবর্তন সাধিত হয়নি । অনুর্বর জমি হওয়া সত্ত্বেও উন্নত দেশসমূহ যেখানে
বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারছে, সেখানে আমাদের দেশের
কৃষকরা এখনো লাঙল-জোয়াল আর গরু-মহিষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। বাংলাদেশে শতকরা
৮০ ভাগ কৃষক এখনো সচেতনতা,
শিক্ষা
ও মূলধনের অভাবে প্রচুর শ্রম দিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফসল পাচ্ছে না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে
কৃষিকাজ না করাই এর অন্যতম কারণ।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা : কৃষিকাজে
বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে বাংলাদেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের
ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এদেশের আবাদি জমির তুলনায় জনসংখ্যা অনেক
বেশি। বর্ধিত জনসংখ্যার আবাসনের চাহিদা মেটাতে সেই কৃষিজমিতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন
বাড়িঘর। ফলে কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। অভাব দেখা দিচ্ছে খাদ্যশস্যের। এ বিশাল
জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হলে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই । তাই বৈজ্ঞানিক
যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকাজে উন্নতি সাধন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক : কৃষিব্যবস্থায়
বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি কিছু খারাপ প্রভাবও
লক্ষ করা যাচ্ছে। অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, বৃষ্টির
পানির সাথে মিশে পুকুরের মাছ চাষে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সার ও কীটনাশকের রাসায়নিক
পদার্থ বাতাসের সাথে মিশে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ তার ভারসাম্য
হারাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। তাই বিজ্ঞানের সচেতন
ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিকাজে উন্নতির প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কৃষিকাজের গুরুত্ব: মানবজীবনে
কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। এ পৃথিবীতে কৃষিকাজ দিয়েই মানুষ তার কর্মজীবনের সূত্রপাত
করেছিল। কৃষির ওপর নির্ভর করেই মানবজীবনের ধারা এখনও বয়ে চলেছে এবং চলবে। বিশ্বের
বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষি এবং তাদের জাতীয় উন্নয়নও কৃষির ওপর
নির্ভরশীল । মানবজাতির জন্যে তাই কৃষির গুরুত্ব বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা অনবরত
গবেষণার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করছেন।
আমাদের দেশের কৃষক ও কৃষি: আমাদের
দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। দেশের শতকরা প্রায় ৭৯ ভাগ লোকই কৃষিজীবী। কিন্তু
দুঃখের বিষয় এই যে,
উন্নত
দেশগুলোতে কৃষিকাজের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও আমাদের
দেশে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এখনও প্রাচীন আমলের মতো কৃষকেরা
কৃষিকাজের জন্যে জীর্ণ-শীর্ণ গরু আর লাঙল ব্যবহার করছে। কৃষকদের অবস্থাও শোচনীয়।
কৃষিকাজের জন্যে তারা প্রয়োজনীয় মূলধন যোগাতে পারে না। তারা নিরক্ষর তাই উন্নত ও
আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের উপযোগী জ্ঞান ও অর্থ তাদের নেই। ফলে আমাদের
কৃষিব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সংগতি রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিবর্তনের
সিঁড়ি বেয়ে গোটা বিশ্ব আজ অপ্রতিহত গতিতে ধেয়ে চলেছে উন্নয়নের স্বর্ণ-শিখরের
পানে। দিনবদলের পালায় বাংলার কৃষক আর কৃষি আজও সেই তিমিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যুগ
তরঙ্গ তাদের মাঝে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই আজও বাংলার কৃষক প্রকৃতির
খেয়াল-খুশির খেলনা হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশের হতভাগ্য
অসহায় কৃষকের ইতিবৃত্তে বলেছেন, ‘ওই যে দাঁড়ায় নত শির মূক সবে, ম্লানমুখে
লেখা শুধু শত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনি, স্কন্ধে যত চাপ তার বহি
চলে মন্থরগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার।
কৃষিকাজে বিজ্ঞান: একবিংশ শতাব্দীর
সূচনালগ্নে বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর কোনো কাজেই বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি নেই। বিজ্ঞানের
জয়যাত্রা আজ সর্বত্র অব্যাহত। বিজ্ঞানের বদৌলতে অন্ধকার ধরণী আজ আলোকাভায়
প্রোজ্জ্বল। বিজ্ঞানের বদৌলতেই আজ ঊষর মরু হয়েছে সরস ও উর্বর, দুর্গম
পাহাড়ের উপত্যকা ও অধিত্যকা এসেছে চাষের আওতায়। নদী পেয়েছে নতুন গতি, শুকনো
ক্ষেতে চলছে জল-সিঞ্চন। জগৎ ও জীবনের কর্মপ্রবাহের প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান তার
অবদানের সাক্ষর রেখে চলেছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বর্তমান শতাব্দীতে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের
ব্যবহারকে সাফল্যজনক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের
প্রয়াসে নিবিড় চাষের জন্যে যান্ত্রিক সরঞ্জামের আবিষ্কার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের
সূচনা করেছে। ট্রাক্টর ও পাওয়ার-টিলারের সঙ্গে আরও নানা ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম
ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার মানুষ ও পশুশ্রমকে মুক্তি দিয়েছে। গোবর সার, কম্পোস্ট
সার ও সবুজ সারের স্থলে রাসায়নিক সার; যেমন- ইউরিয়া, টিএসপি, এসএসপি
ইত্যাদির আবিষ্কারের ফলে একর প্রতি উৎপাদন দ্বিগুণের ওপরে চলে গেছে। একই সঙ্গে
উল্লেখ করা যায়,
বিভিন্ন
ফসলের ক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজ আবিষ্কারের কথা। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান
গবেষণা কেন্দ্রে ইরি ধান আবিষ্কৃত হয়। এরপর বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
ইরি-৮ নামক উচ্চ ফলনশীল ধান আবিষ্কার করে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
সাধন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী নর্মান বেরলগের মাক্সিপাক ও অন্যান্য জাতের উচ্চ
ফলনশীল গম আবিষ্কার করে কৃষিতে বিজ্ঞানের এক মহতী উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কৃষিকাজে
বিজ্ঞানের প্রয়োগজনিত সাফল্য শুধু ধান ও গমের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের
এ সাফল্য প্রায় সকল ধরনের ফল- ফলারি ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই সাধিত হয়েছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে পোকা-মাকড় দমন ও নির্মূল করার ক্ষেত্রে
বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটেছে অন্য সকল ক্ষেত্রের মতোই। নানা ধরনের পোকার আক্রমণ থেকে
শস্যকে রক্ষার জন্যে ইনসেকটিসাইড বা পোকা দমনকারী বহু রাসায়নিক দ্রব্য আবিষ্কৃত
হয়েছে। এর মধ্যে এন্ড্রিন,
ডায়াজিন, ক্লোর
ছাড়াও রয়েছে অনেক পোকা ধ্বংসকারী ওষুধ।
বিভিন্ন দেশের কৃষিকাজে বিজ্ঞান: বর্তমানে
উন্নত দেশগুলোতে কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। জমি
কর্ষণ থেকে শুরু করে বীজ বপন, ফসলের আগাছা পরিষ্কার, সেচকার্য, ফসল
কাটা,
মাড়াই
করা ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই তারা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি
তাদের কৃষিকাজে এখন আর অন্তরায় হয় না। শীতপ্রধান দেশে শীত নিয়ন্ত্রিত ঘর অর্থাৎ
গ্রিন হাউজ তৈরি করে সেখানে শাক-সবজি, ফল-মূল উৎপন্ন করা হচ্ছে।
প্রযুক্তির সহায়তায় মরুভূমির মতো জায়গাতেও সেচের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন
প্রক্রিয়ায় ফসল ফলানো হচ্ছে। ফলে দেখা যায়, কৃষিকার্যে বিজ্ঞান এক
যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছে।
আমাদের দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান: উন্নয়নশীল
দেশ হিসেবে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যাপক ব্যবহার আমাদের দেশে সম্ভব হচ্ছে না। তবে
সীমিত আকারে আমাদের কৃষিতে বিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে এবং কৃষিব্যবস্থার
উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। জমির খণ্ড-বিখণ্ডতার
কারণে জমি কর্ষণে এখনও অনেক জায়গায় ট্রাক্টর ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। সেচকার্যের
জন্যে গভীর নলকূপ ও মেশিন চালিত পাম্প ব্যবহৃত হচ্ছে। বীজ সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক
প্রযুক্তি ও উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে সার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ইতোমধ্যে
স্বল্পমাত্রায় হলেও কৃষির উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি
পর্যায়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
দৃষ্টান্ত: বিস্ফোরণোন্মুখ জনসংখ্যার
ভারে বাংলাদেশ আজ ন্যুব্জ। জনসংখ্যার গুরুভার সৃষ্টি করেছে প্রকট খাদ্য সমস্যা।
আমাদের কৃষির প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা বজায় রেখে
কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। আমাদের মাটির তুলনায় জাপানের মাটির স্বাভাবিক
উৎপাদনক্ষমতা এক চতুর্থাংশ। অথচ তারা কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে
লাগিয়ে আমাদের চেয়ে অধিক ফসল ফলিয়ে খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্র,
ফিলিপাইন, চীন, কোরিয়াসহ
বিভিন্ন দেশের কৃষিকে আমরা এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে পারি।
আমাদের কৃষক এবং আধুনিক শিক্ষা ও যুক্তি: আমাদের
কৃষক সম্প্রদায় এখনও অনেক জায়গায় জমি চাষের জন্যে গবাদিপশু চালিত লাঙল ব্যবহার
করে। এ ব্যবস্থা যেমনি কষ্টকর তেমনি সময়সাধ্য। এ কাজে আমরা ট্রাক্টর ব্যবহার করে
অল্প সময়ে অধিক জমিতে চাষাবাদ করতে পারি। কৃষিজমির মান অনুযায়ী রাসায়নিক সার ও
কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে । উন্নত দেশসমূহের
মতো আমরাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধিক উৎপাদন করে আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে
পারি। বলতে গেলে মানুষের মৌলিক চাহিদার সবটাই যোগান দেয় কৃষি। তাই কৃষিকে অবহেলা
করে বেঁচে থাকা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণসাধনও
অসম্ভব। আশার কথা,
এদিকে
লক্ষ রেখেই সরকার কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন হয়ে উঠছে।
কৃষিব্যবস্থারসামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থেএদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি
কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কৃষিকে মাধ্যমিক স্তর থেকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা
হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মানবজীবনে কৃষির গুরুত্ব : কৃষি
মানুষের অস্তিত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। মানবজীবন ও মানবসমাজে এর গুরুত্ব
অপরিসীম। জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এটি মানুষের আদিমতম জীবিকার উপায়। দেশে দেশে কৃষিই
সমাজের মেরুদণ্ড,
কৃষিই
সমাজের ভিত্তি। স্বভাবতই কৃষির ক্রমোন্নতিতেই সমাজের ও দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি।
এই উন্নতিতে অনন্য ও অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে বিজ্ঞান। আজকের বিশ্বে প্রতিটি
ক্ষেত্রের মতো কৃষিক্ষেত্রেও বিজ্ঞানই আজ বাড়িয়ে দিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী
কল্যাণী হাত
কৃষির আধুনিকায়নে বিজ্ঞান : আঠারো
শতকের শেষদিকে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির
আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে। এর ফলে কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ও
কৃষিপদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়। জন্তু আর কাঠের লাঙলের পরিবর্তে কৃষকদের হাতে আসে
কলের লাঙল,
ট্রাক্টর
ও পাওয়ার টিলার। বিজ্ঞানের কল্যাণে উন্নত দেশগুলোতে জমিকর্ষণের পুরোনো পদ্ধতিগুলো
লোপ পেয়েছে। সেচব্যবস্থাতেও বিজ্ঞান অনেক পরিবর্তন এনেছে। কৃষকদের এখন ফসলের
জন্যে প্রকৃতির মুখাপেক্ষী হয়েথাকতে হয় না। গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে জমিতে
পানিসেচের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রেসেচের জন্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে
ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎশক্তি চালিত পাম্প। অতিবৃষ্টিও আজ কৃষককে ভীত করছে না।
বিজ্ঞানের বদৌলতে জমির
অতিরিক্ত
জল নিষ্কাশন আজ অত্যন্ত সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম
বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছেন। উন্নতমানের
বীজ উৎপাদনে বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তাও অভাবনীয়। বিশেষ করে
কৃত্রিম উপায়ে উচ্চফলনশীল বীজ উৎপাদনে সাফল্য বিস্ময়কর। এসব বীজ সাধারণ বীজের
তুলনায় ফসল উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম নেয়। সুতরাং বীজ নিয়ে কৃষকদের
অতীতের অনিশ্চয়তা দূর করেছে বিজ্ঞান। শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায়
ফসল উৎপাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বৃষ্টিহীন শুষ্ক মরু
অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু করার প্রচেষ্টা চলছে বিজ্ঞানের সহায়তায়। সেদিন দূরে নয়
যেদিন এ ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা সাফল্য অর্জন করবেন।
উন্নত বিশ্বের কৃষি : উন্নত দেশগুলোর
কৃষিব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিজ্ঞাননির্ভর। জমিতে বীজ বপন থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা
পর্যন্ত সমস্ত কাজেই রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক
কৃষিযন্ত্র,
যেমন
: মোয়ার (শস্য-ছেদনকারী যন্ত্র), রূপার (ফসল কাটার যন্ত্র), বাইন্ডার
(ফসল বাঁধার যন্ত্র),
থ্রেশিং
মেশিন (মাড়াই যন্ত্র),
ম্যানিউর
স্প্রেডার (সার বিস্তারণ যন্ত্র) ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোর কৃষিক্ষেত্রে এনেছে
বৈপ্লবিক সাফল্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া
প্রভৃতি দেশের খামারে একদিনে ১০০ একর পর্যন্ত জমি চাষ হচ্ছে কেবল এক-একটি
ট্রাক্টরের মাধ্যমে। সেগুলো আবার একসাথে তিন- চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একত্রে
কাজে লাগাতে সক্ষম। তারা বিভিন্নভাবে কৃষিকাজের এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে যার
ফলে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অগ্রগামী। যেমন বলা
যায় জাপানের কথা। জাপানে জমির উর্বরাশক্তি বাংলাদেশের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে তারা এ দেশের তুলনায় ৬ গুণ বেশি ফসল
উৎপাদন করছে।
কৃষি ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর
দেশ। এ দেশের মাটি ও জলবায়ু বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় কৃষির অনুকূলে ।
কিন্তু উন্নত দেশগুলো যখন প্রতিকূল অবস্থা ঘুচিয়ে ফসল উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক নেশায়
মেতেছে,
সেখানে
বাংলাদেশের কৃষকেরা তার কাঠের লাঙল আর একজোড়া জীর্ণ-শীর্ণ বলদ নিয়ে চেয়ে আছে
আকাশের পানে বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে জমি চাষের জন্য প্রায় ১ লক্ষ ইঞ্জিন চালিত চাষযন্ত্র ব্যবহৃত
হচ্ছে। এ ছাড়াও কৃষিকাজে ট্রাক্টর, সিডড্রিল (গতখনক), ধান-বুনন
যন্ত্র,
বিরিড্রাম
সিডার,
স্প্রেয়ার, উন্নত
সেচ-পাম্প,
ড্রায়াফ্রাম
পাম্প,
ট্রেডল
পাম্প,
রোয়ার
পাম্প,
শস্যকাটা
যন্ত্র,
ঘাসকাটা
যন্ত্র,
মাড়াই
যন্ত্র ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ছে। এ কথা অবশ্য সত্যি যে বাংলাদেশেও কৃষি নিয়ে
গবেষণা হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সফলতা এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের শতকরা
আশিভাগ কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে চলেছে। শিক্ষা, সচেতনতা, মূলধন, পুঁজি
ইত্যাদির অভাবে তারা কৃষিকাজে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারা শ্রম দিচ্ছে কিন্তু
উপযুক্ত ফসল পাচ্ছে না। কেননা তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করতে পারছে না।
উপসংহার : কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ
বাঁচবে- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে শিল্পোন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে কৃষিকাজে
বিজ্ঞানের ব্যবহার প্রসারিত করতে হবে। সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে কৃষির বিকল্প নেই-
এসত্য উপলব্ধি করে বাংলাদেশ সরকার কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি
ব্যবহারে সচেতন হয়েছে। এজন্য গ্রামে-গঞ্জে বিনামূল্যে বীজ বিতরণের আশ্বাস দিয়েছে
সরকার। দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে যাতে শিক্ষক এ
ছাত্র গ্রামে গিয়ে কৃষকদের কৃষি কাজে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দিতে পারে। কৃষকদের
আধুনিক পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের কৃষির
উন্নতিতেই দেশের সামাজিক উন্নতি নির্ভর করছে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, বর্তমানে
ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াসহ প্রিন্ট মিডিয়াতে ব্যাপকহারে কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য
সচেতনমূলক অনুষ্ঠান ও আলোচনা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞান আজ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের সাহায্যে পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিভিন্নভাবে কৃষিজমি তৈরি করা হচ্ছে। ফসল আবাদের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা বিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ তারা কৃষিক্ষেত্রে লাভ করছে বিরাট সাফল্য। কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সুজলা-সুফলা আমাদের এই দেশে বিজ্ঞানের জাদুর ছোঁয়া আমরা যত বেশি কাজে লাগাতে পারব ততই কৃষি আমাদের দেবে সোনালি ফসলসহ নানা ফসলের সম্ভার। কৃষকদের সচেতনতা, সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সাহায্য প্রদান এবং বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাই পারে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে বাংলাদেশকে একটি সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা দেশ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ কৃষিকাজে
বিজ্ঞান রচনা
শিক্ষার্থীরা আজকে আমরা
জানলাম কৃষিকাজে
বিজ্ঞান রচনা সম্পর্কে
। যদি আজকের
এই কৃষিকাজে
বিজ্ঞান রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই
রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD
Post a Comment